Press ESC to close

শিশুকে শক্ত খাবার খাওয়ার অভ্যাস তৈরির জন্যএকটি গাইড

মনে হয় যেন কিছুক্ষণ আগেই আপনার ছোট্ট সোনামণি পৃথিবীতে এসেছে, আর এখন আপনি তাদের খাদ্যতালিকায় কঠিন খাবার যোগ করার কথা ভাবছেন। সময়টা কীভাবে দ্রুত চলে যায়!

শিশুর জন্য শক্ত খাবার খাওয়ানোর প্রক্রিয়াটি হতে পারে একদিকে আনন্দদায়ক এবং অন্যদিকে একটু চ্যালেঞ্জিং। এমনকি যেসব বাবা-মা এর আগেও এই ধাপটি পেরিয়েছেন, তারাও নতুন করে ভাবতে বাধ্য হন। কারণ প্রতিটি শিশু একেবারেই আলাদা।

শিশুকে শক্ত খাবার খাওয়ানোর সময় বিশৃঙ্খলা হতে পারে। আপনি হয়তো নানা রকমের ছড়া কিংবা নানা রকমের শব্দ করে আপনার ছোট্ট সোনামণিকে নতুন কিছু খাওয়ানোর জন্য উৎসাহিত করতে চেষ্টা করবেন। এটি একটি অসাধারণ সময়, যেখানে আপনি এবং আপনার সন্তান একসঙ্গে নতুন একটি অভিজ্ঞতার সাথে পরিচিত হতে পারবেন। একসঙ্গে নতুন স্বাদ, রঙ, এবং স্পর্শ আবিষ্কার করবেন – এমনকি দাগ লাগানোর অভিজ্ঞতাও থাকবে। এটি নিঃসন্দেহে একটি রোমাঞ্চকর যাত্রা। শিশুর পুষ্টি এবং সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার পাশাপাশি এই ধাপটি তাদের খাদ্যাভ্যাস বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়।

তবে শিশুর জন্য শক্ত খাবার খাওয়ানোর এই প্রক্রিয়াটি যতই উত্তেজনাপূর্ণ হোক, এটি ধীরে এবং যত্নসহকারে শুরু করা উচিত।

সাফল্যের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশিকা অনুসরণ করুন।

 

কখন শিশুকে শক্ত খাবার খাওয়ানো শুরু করবেন?

শক্ত খাবার খাওয়ানো শুরু করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম নেই। তবে, এনএইচএস (NHS) নির্দেশিকায় উল্লেখ করা হয়েছে যে শিশুদের পেট এবং পরিপাকতন্ত্র সম্পূর্ণভাবে বিকশিত হওয়ার জন্য ছয় মাস বয়সের পর বা কাছাকাছি সময়ে শক্ত খাবার খাওয়ানো শুরু করাই উত্তম। যদিও কিছু শিশু ছয় মাস বয়সে এর জন্য প্রস্তুত নাও হতে পারে। যদি আপনার সন্তানের জন্য সঠিক সময় নিয়ে সন্দেহ থাকে, তাহলে স্বাস্থ্য পরামর্শকের সঙ্গে কথা বলুন।

কিছু লক্ষণ ও সংকেত রয়েছে যা ইঙ্গিত দেয় যে আপনার শিশু শক্ত খাবার খাওয়ার জন্য প্রস্তুত। এগুলোর মধ্যে রয়েছে মুষ্টি চিবানোর প্রবণতা, রাতের ঘুমের ধরণে পরিবর্তন, অতিরিক্ত দুধ চাওয়া ইত্যাদি। যদি আপনার শিশু ছয় মাস বয়স পেরিয়ে যায় এবং এখনও নিশ্চিত নন, তাহলে তাদের একটু স্বাদ নিতে দিন এবং দেখুন কীভাবে তারা প্রতিক্রিয়া জানায়।

 

শক্ত খাবার খাওয়ানোর জন্য কি কি কিনতে হবে?

শিশুর জন্য শক্ত খাবার খাওয়ানোর প্রস্তুতি নেওয়ার সময় ফ্যাশনেবল এবং দামি সরঞ্জামের পেছনে প্রচুর টাকা খরচ করার প্রয়োজন নেই। যদিও বাজারে অনেক আকর্ষণীয় এবং ব্যয়বহুল সরঞ্জাম পাওয়া যায়। তবে আসলেই যা প্রয়োজন তা হলো:

  • নরম প্লাস্টিকের চামচের সংগ্রহ: সুপারমার্কেট, ওষুধের দোকান বা ধাত্রী থেকে পাওয়া শিশুর ফ্রি গুডি ব্যাগে এই চামচগুলো অনেক সময় পাওয়া যায়। আপনার কাছে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু থাকতে পারে।
  • অনেকগুলো (বিব): শুরুতে নরম সুতি কাপড় ব্যবহার করতে পারেন, তবে দ্রুতই পরিষ্কারযোগ্য বিব এর দিকে চলে যাওয়া ভালো (বিশেষত ঝামেলার কথা বিবেচনা করে!)।
  • একটি ব্লেন্ডার বা এই ধরণের যন্ত্র: খাবার মসৃণ করতে একটি ব্লেন্ডার জরুরি। যদিও শিশুদের জন্য নির্দিষ্ট কিছু সরঞ্জাম পাওয়া যায়। একটি সাধারণ ব্লেন্ডার বা হাতের ব্লেন্ডারও কাজ চালিয়ে নেবে।
  • উঁচু চেয়ার বা সিট: খাওয়ার সময় শিশুর সঠিকভাবে বসতে পারা গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য একটি বিশেষ সিট, উঁচু চেয়ার, বা এমন কোনো চেয়ার যেটি ডাইনিং বা রান্নাঘরের চেয়ারে লাগানো যায়, এগুলোই যথেষ্ট।
  • শিশুর পরিষ্কার করার জন্য বেবি ওয়াইপস বা ভেজা টিস্যু এবং কিচেন রোল: শুরুর দিকে খুব বেশি ঝামেলা না হলেও, যখন শিশু রঙিন খাবার বা বাটিতে হাত দিতে শুরু করবে, তখন পরিষ্কার করার সরঞ্জাম কাছে রাখা খুবই দরকার।
  • প্লাস্টিকের বাটি এবং প্লেট: প্রথম যখন শিশুরা চামচ বা বাটি ধরার চেষ্টা করবে, তখন তা মেঝেতে পড়ার ঝুঁকি থাকে। প্লাস্টিকের বাটিগুলো সিরামিকের চেয়ে অনেক ভালোভাবে ঝাঁকুনি সহ্য করতে পারে।

এই সাধারণ সরঞ্জামগুলো দিয়ে আপনি সহজেই কঠিন খাবার খাওয়ানোর যাত্রা শুরু করতে পারবেন।

 

কোথা থেকে শুরু করবেন

শক্ত খাবার খাওয়ানোর প্রথম সপ্তাহেই আপনার শিশু পুরোপুরি তিনবেলার খাবারে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে না। প্রথমে তাদের শিখতে হবে চামচ থেকে খাবার নেওয়া, মুখে ঘুরিয়ে খাওয়া এবং তা গিলে ফেলা। কোন শিশু সহজেই এটি শিখে নেয়, আবার কাউকে হয়তো একটু বেশি উৎসাহ দিতে হতে পারে। এরপরে নতুন ধরণের স্বাদ ও গঠনের সাথে মানিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়।

অধিকাংশ বাবা-মা সাধারণত শিশুর জন্য প্রথম খাবার হিসেবে শিশুর চালের গুঁড়া বা শিশু পোরিজ (Baby Porridge) দিয়ে শুরু করেন।

 

 

 

 

 

পরবর্তী ধাপ

শিশুর চামচ ব্যবহারের অভ্যাস, খাবার মুখে রাখার এবং সবকিছু থুতু ফেলে না দেওয়ার প্রাথমিক ধাপগুলো পেরিয়ে যাওয়ার পর, পরবর্তী ধাপে নতুন স্বাদ, বিভিন্ন উপাদানের সংমিশ্রণ এবং পরিমাণ ধীরে ধীরে বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়। এই পর্যায়ে শিশুকে ধীরে ধীরে দিনের বিভিন্ন সময়ে বৈচিত্র্যময় ও নিয়মিত খাবারে অভ্যস্ত করানো হয়।

প্রথম খাবার হিসেবে সাধারণত মাখানো বা পিউরি করা সবজি যেমন গাজর, আলু, ফুলকপি ইত্যাদি দেওয়া হয়। সময়ের সাথে শিশুটি মিষ্টি ও ঝাল উভয় ধরনের খাবার উপভোগ করতে শুরু করবে এবং ধীরে ধীরে আপনার খাবারের মতোই খেতে শুরু করবে। তবে তা হবে পরিমাণে ছোট এবং নরম বা মাখানো।

শিশুদের খাবার তৈরি করার সময় লবণ যোগ না করা এবং গ্রেভি বা অন্য উপকরণে লবণের পরিমাণ সম্পর্কে সতর্ক থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পুষ্টিকর এবং সঠিকভাবে প্রস্তুত খাবার সরবরাহ করা হলে, একবার শিশুর খাবার খাওয়ার প্রক্রিয়া সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হলে, তারা পরিবারের বাকি সদস্যদের মতোই একই ধরনের খাবার খেতে পারবে।

আরও ভালো, যদি আপনি টেবিলে বসে শিশুর সাথে খাওয়ার সময় কাটান। এটি প্রাথমিক পর্যায় থেকেই ভালো খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে সহায়তা করবে।

 

অর্গানিক খাবার

অর্গানিক খাবার সেরা কিনা তা নিয়ে বেশ কিছু প্রকাশ্য বিতর্ক হয়েছে। কিছু মানুষ মনে করেন এটি সেরা, আবার কিছু মানুষের কাছে এটি তেমন প্রাধান্য পায় না এবং অবশ্যই এর মূল্যও একটি বিষয়। এখন পর্যন্ত কোনো নির্দিষ্ট নির্দেশিকা নেই, যেখান হতে নিশ্চিত করা যায় যে শিশুরা বা ছোটরা শুধুমাত্র অর্গানিক খাবারই খাওয়া উচিত। সুতরাং যদি আপনি এই বিষয়টি নিয়ে বিশেষভাবে দৃঢ় মতামত না রাখেন, তবে আপনার কেনাকাটার অভ্যাসে কোনো পরিবর্তন আনার প্রয়োজন নেই যাতে অর্গানিক খাবার অন্তর্ভুক্ত থাকে।

 

আপনার শিশুর খাদ্যাভ্যাস পর্যবেক্ষণ

আপনার শিশুর পছন্দ এবং অপছন্দ নিয়মিত পরিবর্তিত হবে, এবং হয়তো তারা এখন মাখানো পার্সনিপ পছন্দ করে না, কিন্তু তিন বা ছয় মাস পরে সেটি তাদের প্রিয় খাবার হয়ে উঠতে পারে। আপনি যে খাবারগুলো করেছেন এবং সেগুলো কেমনভাবে গ্রহণ করেছে তার একটি মৌলিক রেকর্ড রাখা ভাল। যদি কোনো খাবার তারা প্রত্যাখ্যান করে, কিছু সপ্তাহ বা মাস পরে আবার চেষ্টা করুন।

আপনার শিশুর খাওয়া এবং কখন খেয়েছে তা পর্যবেক্ষণ করা, শিশুর কোনো অস্বস্তি বা অ্যালার্জি শনাক্ত করার জন্য সহায়ক হতে পারে। যদি আপনার শিশুর কোনো অস্বস্তি বা অ্যালার্জি নিয়ে উদ্বিগ্ন হন, তাহলে আপনার স্বাস্থ্য পরামর্শক এর সাথে পরামর্শ করা উচিত।

 

খাদ্য অ্যালার্জি এবং অস্বস্তি সম্পর্কিত আরও তথ্য

খাবারের প্রতি অস্বস্তি বা অ-সহিষ্ণু থাকা শিশুর জন্য খুবই অস্বস্তিকর হতে পারে। এটি গ্যাস, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া এবং বমি সৃষ্টি করতে পারে। খাদ্য অ্যালার্জি আরও গুরুতর হতে পারে, কারণ এটি একটি উল্লেখযোগ্য এবং বিপজ্জনক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।

যদি আপনার পরিবারের কেউ অ্যালার্জিতে ভোগেন বা আপনার শিশু হাঁপানি বা একজিমা রোগে ভুগছেন, তবে খাবার নির্বাচনের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সতর্ক হওয়া উচিত। অনেক বাবা-মা তাদের শিশু খুব ছোট বয়সে খাদ্য অ্যালার্জি সৃষ্টি করতে পারে এমন খাবার, বিশেষ করে বাদাম এবং শেলফিশ থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেন।

যদি আপনি আপনার পরিবারের অ্যালার্জি বা অস্বস্তি সম্পর্কে জানেন, তবে আপনি সম্ভবত ইতিমধ্যেই সাবধানতার সাথে খাবার নির্বাচন করছেন, এবং হয়তো কিছু খাবার শিশুর বয়স আরও বাড়ানোর পর দেয়ার পরিকল্পনা করছেন এবং তাদের খাওয়া মনিটর করছেন। এই কারণে, শিশুর খাওয়ার অভ্যাসের একটি রেকর্ড রাখা বিশেষভাবে উপকারী হতে পারে, বিশেষত খাবার সম্পর্কিত সমস্যা নির্ণয়ে।

এটা উল্লেখযোগ্য যে, একটি শিশু অ্যালার্জি বা অস্বস্তিতে ভুগতে পারে এমন অনেক খাবারের প্রতি, পরিবারে ইতিহাস থাকুক বা না থাকুক, তাই সতর্ক থাকতে হবে। যদি কোনো সন্দেহ থাকে, তাহলে আপনার স্বাস্থ্য পরামর্শকের সাথে পরামর্শ করুন।

 

পানীয় সম্পর্কিত পরামর্শ

এটি গুরুত্বপূর্ণ যে শিশুরা কমপক্ষে ছয় মাস বয়স না হওয়া পর্যন্ত তাদের মাতৃদুগ্ধ বা ফর্মুলা দুধ খায় (NHS গাইডলাইন অনুযায়ী, ছয় মাস বয়স পর্যন্ত দুধ শিশুর সমস্ত পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে)। খাদ্য পরিচয় করানোর সময়েও মনে রাখা উচিত যে দুধ এখনও প্রয়োজনীয়। অনেক পিতামাতা তাদের শিশুকে কমপক্ষে এক বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত দুধ দিতে থাকেন, তারপর চাইলে গরুর দুধ বা অন্য কোনো উপযুক্ত বিকল্পে পরিবর্তন করেন।

পরামর্শ দেওয়া হয় যে, যখন শিশুর শক্ত খাবারের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, তখন ধীরে ধীরে দুধ কমাতে শুরু করুন। সকালে এবং ঘুমানোর আগে পূর্ণ পরিমাণ দুধ খাওয়ানো কিছু সময় অবধি চলতে পারে।

যতটুকু সম্ভব পানি দিয়ে শিশুর হাইড্রেশন বজায় রাখার জন্য, খাবারের মাঝে বা খাবারের সাথে সিপি কাপ বা অন্য কোনো কাপ ব্যবহার করে পানি দেওয়া উচিত।

 

খাদ্য পরিচয় পরিকল্পনা ও সময়সূচি

আপনার শিশুকে কখন এবং কী খাওয়াবেন তার জন্য একটি পরিকল্পনা করা দারুণ একটি ধারণা। এটি শুধু আপনার খাবারের পরিকল্পনা এবং কেনাকাটায় সহায়তা করবে তাই নয়, এটি শিশুর জন্যও উপকারী। তবে, শুরুতেই সব কিছু পরিকল্পনামাফিক না হলে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। যেহেতু প্রতিটি শিশুর বিকাশের গতি আলাদা, প্রতিটি ধাপে কিছু শিশু দ্রুত দক্ষতা অর্জন করে, আবার কিছু শিশু ধীরে। এটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। আপনার প্রতিবেশীর শিশু যদি অ্যাসপারাগাস এবং মিষ্টি আলু খায় আর আপনার শিশু গাজর এবং শিশুর চালের গুঁড়া মুখ থেকে ফেলে দেয়, তাহলে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। তারা প্রস্তুত হলে আপনাকে তা জানাবে।

পরিকল্পনায় নমনীয় থাকতে প্রস্তুত থাকুন এবং মনে রাখুন যে খাদ্য পরিচয় করানো একটি যাত্রা এবং শেখার অভিজ্ঞতা, যা আপনার ও শিশুর জন্য। তাই নতুন খাবার ও স্বাদ পরীক্ষা করা একদিন একদিন করে উপভোগ করা ভালো। যদি আপনার শিশুর খাদ্য পরিচয় করানোর বিষয়ে কোনো সমসসা থাকে, তবে আপনার স্বাস্থ্য পরামর্শক এর কাছে সহায়তা নিন।

 

 

 

 

 

আপনি কীভাবে খাদ্য পরিচয় করানোর অভিজ্ঞতা পেয়েছেন? আপনার কোনো টিপস বা কৌশল রয়েছে? যদি থাকে, তাহলে দয়া করে নিচে মন্তব্য করুন এবং অন্য বাবা-মায়েদের সাথে শেয়ার করুন যারা এই উত্তেজনাপূর্ণ ও মজাদার সময়ে পা রেখেছেন।